তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে আত্মহনন। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি জঘন্যতম মহাপাপ হলেও এ আত্মহত্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। কোনোভাবেই এ প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না। সাংসারিক কলহ-দ্বন্দ্ব, অতিরিক্ত রাগ, অধৈর্য, ক্ষোভ, মান-অভিমান, হতাশা, লজ্জা ও মানহানিকর নানা ঘটনায় বাড়ছে আত্মহত্যা।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে এক মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্কুলছাত্রসহ ৬ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গৌরীপুর থানার ওসি খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী জানান, এসব ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। তদন্ত চলছে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামাবাদ সিনিয়র মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মো. এমদাদুল হক হাদিসের বয়ান দিয়ে বলেন, আত্মহত্যা একটি মহাপাপ।
জানা যায়, মঙ্গলবার ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পৌর শহরের পশ্চিম দাপুনিয়া মহল্লার মো. নুরুল ইসলামের পুত্র মো. সজীব মিয়ার (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সজীব মিয়া নিজের ঘুমানোর টিনের বসতঘরের আড়ার সঙ্গে ফাঁস নেয়। পরিবারের লোকজন উদ্ধার করে তাকে গৌরীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের বাবা মো. নুরুল ইসলাম জানান, সজীবের সিগারেট খাওয়াকে কেন্দ্র করে তার স্ত্রী জলি আক্তারের (১৯) সঙ্গে সকালে কথাকাটাকাটি হয়। ধারণা করা হয়েছে সিগারেট খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মান-অভিমানেই সে আত্মহত্যা করেছে।
১০ ফেব্রুয়ারি পৌর শহরের কালীপুর মধ্যম তরফ এলাকায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র জোবায়ের ইবনে নুর প্রজ্ঞা রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টা ১৫ মিনিটের মধ্যে নিজের পড়ার কক্ষে ফাঁস নেয়। মৃত্যুর পূর্বে একটি চিরকুটে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে লিখে যায়- ‘আমি তোমার অযোগ্য কুসন্তান’। ইবনে নুর প্রজ্ঞা উপজেলার মাওহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ কালন মাস্টারের পুত্র।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টার দিকে উপজেলার সহনাটী ইউনিয়নের পেচাঙ্গীয়া কান্দাপাড়া গ্রামের মো. আবু সিদ্দিকের পুত্র হারেছ মিয়া (৩৫) নিজ বসতঘরে বাঁশের আড়ার (ধন্না) সঙ্গে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে। তিনি পেশায় গরু ব্যবসায়ী ছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পরিবারের কেউ কিছু বলতে পারেনি। তবে সেই দিন তার স্ত্রী মোছা. তাসলিমা আক্তার (৩১) তার বাপের বাড়ি কেন্দুয়া উপজেলার বেখৈরহাটিতে ছিলেন।
একই ইউনিয়নে ১১ জানুয়ারি মায়ের সঙ্গে অভিমান করে তুষার মিয়া (১৫) নামে এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করেছে। সে পাছার উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির ছাত্র। পাছার গ্রামের আব্দুল মান্নানের (এন্ট্রাস মিয়া) পুত্র। মৃত্যুর পর তার পকেট থেকে চিরকুট উদ্ধার করে পুলিশ।
চিরকুটে তার মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে- ‘মা, আমি তোমার আদরের অতি কষ্ট করে বড় করা খারাপ ছেলে। মামার ছেলে অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করে দেওয়ায় তুমি আমাকে বলতা দেখ- তোর ছোট তবু তার মা-বাবাকে খামাই করে খাওয়ায় আর তুই ঘরে বসে বসে সবকিছু খাস আর খাস। অথচ দেখ আম্মা আজ আমি খবর কিছুই নিতে পারলাম না। মা-বাবা আমার বেশি বেশি খাওয়ার জন্য শুধু সংসারে অশান্তি লেগেই থাকতো, মা আল্লাই এই একটা পেট দিসে, না সাগর দিসে, খালি খাই আর খাই করে। আম্মা আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, আমার জীবন এত ভারি হবে। তুমি আল্লাহর কাছে বলছিলা না যে, কত মানুষ গাছে গাছে উঠে কত জায়গায় যায়, আল্লাই কী এরে দেখে না।’
৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মইলাকান্দা ইউনিয়নের সূর্য্যাকোনা গ্রামের মো. চাঁন মিয়ার পুত্র দেলোয়ার হোসেন দিলু (৩৫) লিচুগাছের ডালের সঙ্গে নিজের পরনের লুঙ্গি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। তিনি কিছুদিন যাবত মানসিক যন্ত্রণায় ভুলছিলেন বলে ইউপি মেম্বার মো. এনায়েত হোসেন শাহজাহান নিশ্চিত করেন।
অপরদিকে ২৫ জানুয়ারি ভোরে ভাংনামারী ইউনিয়নের ভোলার আলগী গ্রামের মৃত জামির উদ্দিনের পুত্র শফিকুল ইসলাম (৪৮) নাওভাঙ্গা গ্রামের আলাল উদ্দিনের পতিত জমির ম্যারা গাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। তিনি ২৪ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। সকালে গাছে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার ভাই মো. নুরুল আমিন জানান, সে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল।
এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি এই ইউনিয়নের বয়রা বাজার থেকে অজ্ঞাতনামা (৬০) এক বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার করেছে গৌরীপুর থানার পুলিশ। আঞ্জুমান মুফিদুলের মাধ্যমে এ লাশ ময়মনসিংহ দাফনকার্য সম্পন্ন করা হয়। তবে তার পরিচয় এখনো জানা যায়নি বলে নিশ্চিত করেন গৌরীপুর থানার এসআই মো. নজরুল ইসলাম।
গৌরীপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আত্মহনন ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক সম্প্রীতি বৃদ্ধির জন্য আমরা প্রচার-প্রচারণা করছি।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে মাওলানা সাইদ হোসাইন বলেন, আত্মহত্যা ইসলামি শরিয়তে জঘন্যতম একটি পাপ, যার একমাত্র শাস্তি জাহান্নাম। আত্মহত্যা ইহকাল পরকাল উভয়ই ধ্বংস করে দেয়। যে কোনো কারণেই হোক না কেন আত্মহত্যা মহাপাপ। জঘন্যতম পাপ।
সূত্রঃ যুগান্তর