সাড়ে পাঁচশ দিন পর নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে শিক্ষার্থীরা। তাই রোববার আয়োজনের কমতি ছিল না সারা দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। অনেক জায়গায় ব্যান্ড বাজিয়ে ফুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীদের চকলেট উপহার দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো স্কুল বেলুন দিয়ে সাজানো হয়। এদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে প্রতিটি ক্যাম্পাস। নিজ ভুবনে ফিরতে পেরে ছাত্রছাত্রীরাও দারুণ খুশি। পাশাপাশি সব স্কুল-কলেজেই সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়েছে। স্কুলে ঢোকার আগে শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মাপা, পরে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করা হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
বগুড়া : সকাল ৭টার আগেই বগুড়া শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ফটক খুলে দেওয়া হয়। লাইন ধরে ও দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। প্রবেশমুখে তাদের হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করা হয়। এরপর তারা লাইন ধরে শ্রেণিকক্ষের সামনে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। শিক্ষকরা প্রতিটি শিক্ষার্থীর শরীরের তাপমাত্রা দেখার পরই ক্লাসে ঢুকতে দেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ সময় বেশ উৎফুল্ল দেখা যায়। অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান জানান, এদিন পঞ্চম শ্রেণির ৪৫২ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৩৮৮ জন উপস্থিত ছিল। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কাউট দলের সদস্যরা ব্যান্ড বাজিয়ে ও ফুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করেছে। জেলার অপর স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। পঞ্চম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্রছাত্রী জানায়, ভালো থাকা ও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত খোলা থাকার স্বার্থেই তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে।
রাজশাহী : সকাল থেকেই রাজশাহী মহানগরীর সড়কগুলোতে স্কুল ড্রেস পরে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ছিল। কয়েকটি সিফটে ক্লাস নেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছিল। প্রাণের ক্যাম্পাসে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। অনেক অভিভাবকও সকাল থেকেই স্কুলের সামনে সন্তানের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। কিছু শিক্ষার্থীকে ইউনিফর্ম ছাড়া ক্লাসে ফিরতে দেখা গেছে। রাজশাহী গভ. ল্যাবরেটরি উচ্চবিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইকবারুল রহমান বলে, আমি নতুন স্কুল ড্রেস ও মাস্ক পরে স্কুলে এসেছি। সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও নিয়েছি। একই শ্রেণির শিক্ষার্থী শাকিব হাসান রিমন, তাওসিফ বিন রেজা, সাইদ তমালসহ তাদের সহপাঠীরা জানায়, অনেক দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসরুমে দেখা হলো। খুবই ভালো লাগছে। রাজশাহী কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী মুসাব্বিহুর রহমান বলেন, অনেক দিন পর সরাসরি ক্লাস করলাম। এটি অন্যরকম এক ভালোলাগা। অনলাইনে ক্লাস করে সেরকম তৃপ্তি পাওয়া যেত না।
সিলেট : নগরের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশের সময় ফুল দিয়ে বরণ করে নেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। আর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শরীরের তাপমাত্রা মাপার পর শিক্ষার্থীদের হাত ধুইয়ে অথবা হাত স্যানিটাইজ করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে বলা হয়। নগরীর জিন্দারস্থ সিলেটের সরকারি কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যান্ড বাজিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান শিক্ষকরা। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে স্কুলে আসতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে ঢোল, বাঁশি, ঝুনঝুনি বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করা হয়। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা মাপা হয় ও হাত ধোয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। সরজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে ভবনের ফটক পর্যন্ত বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে কোভিড সচেতনতামূলক বার্তা লিখে রাখা হয়েছে।
বরিশাল : বরিশাল জিলা স্কুলে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী। রোববার স্কুল খুললেও ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের তেমন কোলাহল ছিল না। ক্যাম্পাসও অনেকটা ফাঁকা ছিল। কারণ প্রথম দিন ক্লাস হয় এসএসসি এবং ৫ম শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের। নিয়মিত ক্লাস হবে তাদের। অন্য শ্রেণির ক্লাস হবে সপ্তাহে একদিন। রোববার প্রথম দিন ক্যাম্পাসে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ছিল কর্তৃপক্ষের। ঢুকতে দেওয়া হয়নি অভিভাবকদের। দীর্ঘদিন পর স্কুলে আসতে পেরে খুশি শিক্ষার্থীরা। বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবা হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি নির্দেশনা শতভাগ রক্ষা করার চেষ্টা করছেন তারা। বিগত দিনে পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কর্তৃপক্ষের বাড়তি নজর থাকবে বলে তিনি জানান।
যশোর : দেড় বছর পর খুলেছে যশোরের ২ সহস্রাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসমিন বলে, স্কুলে ঢোকার সাথে সাথে আমার তাপমাত্রা মেপে, ফুল ও চকলেট দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষকরা। স্কুলে আসতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে। আশা করি এভাবে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সবাই অগের মতো স্কুলে হৈ চৈ করে বেড়াতে পারবো। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সামিয়া আক্তার বলে, দীর্ঘদিন পর স্কুল খোলায় খুব খুশি হয়েছি। আবার বন্ধুদের সাথে দেখা হচ্ছে। ক্লাস শিক্ষকদের সাথে দেখা হয়েছে। জিলা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র তানজিম হোসেন বলে, স্কুলে এসে খুব ভালো লাগছে। এমনিতেই আমাদের জিলা স্কুলের পরিবেশ খুব সুন্দর। তার ওপর স্কুলে এসে দেখি, পুরো ক্যাম্পাসে সাজ সাজ রব। স্কুলের প্রধান ফটকে আলোকসজ্জা। আমাদের ফুল-চকলেট দিয়ে বরণ করে শিক্ষকরা। যশোর জিলা স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শোয়াইব হোসেন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাণ ফিরেছে। আগের মতো স্কুলে শিক্ষার্থীদের হৈ চৈ দেখে খুব ভালো লাগছে।
ময়মনসিংহ : জেলায় প্রায় ৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখর ছিল বিদ্যালয়ের ক্যম্পাস। গেটে সাবান পানি ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা ছিল। শিক্ষার্থীরা হাত ধুয়ে বা স্যানিটাইজ করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে। নগরীর বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাই স্কুল, মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়, আনন্দমোহন সরকারি কলেজ, মুমিনুন্নসা সরকারি মহিলা কলেজ, আলমগীর মনসুর মেমোরিয়াল কলেজ, প্রাইমারি স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেছে।
কুমিল্লা : সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত ছিলেন শিক্ষকরা। ফুল ও চকলেট দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বরণ করে নেওয়া হয়। মর্নিং শিফটে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে ক্লাস শুরু হয়। ডে শিফটে ক্লাস শুরু হয় বেলা ১১টায়। এদিন শহরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। আর গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতি ছিল ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. আবু জাফর খান বলেন, সকালে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়। ১২৫৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২২২ জন উপস্থিত ছিল। শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাদের দেখে মন ভরে গেছে। চান্দিনার গল্লাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মতিন জানান, আমার প্রতিষ্ঠানের দুই ক্লাসে উপস্থিত ৬০ শতাংশের মতো। তারপরও ভালো লাগছে। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থী বাড়বে।
রংপুর : সকাল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছুটতে দেখা গেছে প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে। সবার চোখে-মুখে ছিল বাঁধভাঙা আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। রংপুর নগরীসহ জেলার আট উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল ফটকের সামনে সচেতনতামূলক ব্যানার টানানো, শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ এবং হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলার মাদ্রাসাগুলোতেও সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান হয়েছে। রোববার সকালে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা রংপুর অঞ্চলের পরিচালক এসএম আব্দুল মতিন লস্কর, রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষার উপ-পরিচালক মোজাহিদুল ইসলামসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
খুলনা : জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, সুসজ্জিত প্রতিষ্ঠানগুলো। সকালে শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর তাপমাত্রা পরিমাপসহ হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের ভিড়ও দেখা গেছে। খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা পাবলিক কলেজ, সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খুলনা সরকারি ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি ইকবাল নগর বালিকা বিদ্যালয়, সেন্ট জোসেফস উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, কেডিএ খানজাহান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি মহসিন উচ্চ বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক।
ফরিদপুর : জেলার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের এক হাজার দুইশ ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। কয়েক শিক্ষক জানান, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করেই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। প্রথম দিনে উপস্থিতি কিছুটা কম হলেও আগামী দু’-একদিনের মধ্যে উপস্থিতি বাড়বে বলে ধারণা করছেন তারা।
খবর: যুগান্তর