বছর দশেক হলো লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য শ্যালি ইঞ্জিন চালিত অবৈধ বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত গাড়ির। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরাই মূলত সস্তায় কাজ চালাতে এসব গাড়ি ব্যবহার করে আসছেন। যার অধিকাংশই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা ইট ভাটার নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত হয় পদ্মায় অবৈধ ভাবে উত্তোলন করা বালু পরিবহনে, এমনকি সরকারি উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করছেন ঠিকাদাররা। প্রায় সব দিনই খবরের সন্ধানে থাকা সংবাদকর্মীদের কাছে পৌঁছায় এসব গাড়িতে আহত-নিহতের খবর। তথ্য রয়েছে এসব গাড়ি সম্পূর্ণ অবৈধ। তবুও বৈধ রাস্তায় অবৈধ এসব ভয়ংকর গাড়ি কিভাবে চলছে প্রকাশ্যে। সেটিই এখন উদ্বেগের বিষয়। হবে নিয়ন্ত্রণ না-কি এভাবেই বাড়বে দিনকে দিন! সম্প্রতি দৌলতপুরে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত কথিত স্টিয়ারিং গাড়ির ধাক্কায় মাছরাঙা টেলিভিশনের সাংবাদিক তাশরিক সঞ্চয় গুরুতর আহত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের তুমুল দাবি উঠেছে– সড়কে বন্ধ হতে হবে এসব অবৈধ যান। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে প্রফেশনাল গাড়ি এবং পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক ও কর্মী, এমন দাবি দৌলতপুরের মানুষদের।
সাংবাদিক তাশরিক সঞ্চয় তার অভিজ্ঞতা ও মতামত লিখেছেন এভাবেই– আপনাদের কি অনেক বেশি খরচ হবে!!
শুধুমাত্র দৌলতপুরেই বছরে ৫-৭ টা মৃত্যু, ২০-২৫ জনের পঙ্গুত্ব শ্যালো ইঞ্জিন চালিত অদ্ভুত এই গাড়ির জন্য কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গত এক যুগে। এই গাড়ির ধাক্কায় জাতীয় হ্যান্ডবল দলের গোলরক্ষক, স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ অনেক মৃত্যুর খবরই নাড়া দিয়েছে এলাকাবাসীকে। বহু পরিবার ভোগান্তি বয়ে বেড়াচ্ছে কথিত এই গাড়ির আঘাতের। মৃত্যু হয়েছে অভাবি সংসার রেখে অনেক চালকেরও।
দৌলতপুরের যেকোনো পথে দাঁড়ালে এইসব গাড়ি দেখবেনই হরহামেশাই। সাধারণত স্টিয়ারিং নামে পরিচিত এই গাড়িগুলো ইটের ভাটার ইটের পাশাপাশি অবৈধ ভাবে কাটা মাটি, অবৈধ ভাবে উত্তোলন করা বালু বহনের কাজে ব্যবহার করা হয়।
গাড়িগুলো মনগড়া তৈরি, প্রকৌশলের কোন ব্যাখ্যা নেই। আবার, যারা চালাচ্ছেন তাদেরও পথ চলার নূন্যতম কোন প্রশিক্ষণ নেই। গাড়িও মনগড়া, চালকও চালান অনুমানের ওপর।
গেল বছর খবরের প্রয়োজনে চেষ্টা করেছিলাম শ্যালো ইঞ্জিন চালিত গাড়ির ঘটানো দূর্ঘটনায় বছরে আহত-নিহতের সংখ্যা জানতে। জানা সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ ঘটনাই শেষ হয়েছে বৈঠকি মিমাংসার মাধ্যমে। এসবের অফিসিয়াল তেমন কোন রেকর্ড নেই। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলেও দৌলতপুরের পথঘাটে শ্যালো চালিত গাড়ির দৌরাত্ম দিনদিন বেড়েই চলেছে। মাসখানেক ধরে ভাবছিলাম শ্যালো ইঞ্জিন চালিত গাড়ির দৌরাত্ম নিয়ে নিউজ করবো। টুকটাক প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। আগে বিভিন্ন কাগজে এসব নিয়ে লিখেছিও।
এবার আসি গতকাল আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রসঙ্গে। সকালে ৯টার দিকে বাড়ি থেকে বের হলাম, ১০টায় মিরপুর উপজেলায় একটি পূর্বনির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা কাভার করবো। সেখানে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যাক্তির বক্তব্য রাখার কথা। কেবল ১০-১২ মিনিট বাইক চালিয়েছি। মূল সড়কের বাঁ পাশ ধরে যাচ্ছিলাম। দেড়শো সিসি বাইকে আমার গতি পঞ্চাশের মতো। রাস্তার বাঁ দিকেই ইট ভাটা, ভাটা থেকে উঠে আসা পার্শ্ব রাস্তা। ওই রাস্তা দিয়ে একটা স্টিয়ারিং গাড়ি আসছিলো মাঝারি গতীতে। আমি আর ১০-১৫ হাত গেলে ওই গাড়ির রাস্তার মুখে পৌঁছাবো, শ্যালো চালিত গাড়িটা থাকার কথা আমার থেকে অন্ততঃ ২০ মিটার দূরে। আমি হর্ণ বাজিয়ে চিৎকার করেও ওই গাড়ির চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলাম না। ৪-৫ হাতের মধ্যেই আমি আমার বাইক থামিয়ে দিলাম। কিন্তু স্টেয়ারিং দৃষ্টিপাত, কর্ণপাত না করেই আমার বাইকের সামনের অংশে বাঁ পাশ থেকে উঠে এসে ধাক্কা দিলো। হয়তো ওই চালক চাইলেই থেমে যেতে পারতেন আমার মতো, অথবা মূল রাস্তায় ওঠার আগে দেখে নিতে পারতেন বাঁ পাশ থেকে কেউ আসছে কি-না!
ঘটনাস্থলে লোকজন জড়ো হলো। একজন আন্টি আর একজন বৃদ্ধ আমাকে প্রচণ্ড সাহস দিচ্ছিলেন আর প্রাথমিক সেবা দিচ্ছিলেন। বাইকে আমার এক ভাতিজা ছিলো, ওর কিচ্ছু হয়নি খোদার রহমতে। হেলমেট আর জুতা অনেক ক্ষতি রোধ করেছে আমাদের। পরে দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেই। আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখালাম। ৩-৪ মাসের বিশ্রাম আর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠবো বলে জানিয়েছেন তারা। বাম কাধের হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো..। বিষয়টি আমি সড়ক দূর্ঘটনা হিসাবে মেনে নিতে পারছি না। আমার কাছে নিতান্তই হত্যা চেষ্টা মনে হয়েছে।
যারা কষ্ট পেয়েছেন, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, দোয়া করছেন সবার প্রতি অসামান্য কৃতজ্ঞতা রইলো। ইনশাআল্লাহ দ্রুত সব সারিয়ে উঠবো।
এবার কথা হলো– বছরের পর বছর এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরও কিসের স্বার্থে সম্পূর্ণ অবৈধ এই যন্ত্র পথ চলছে? কেন সবাই দেখেও না দেখার ভাব করছে? আর কত প্রাণ গেলে, আর কত পঙ্গু হলে আপনারা বিষয়টি আমলে নিবেন? না-কি আপনার নিজের পরিবারের লোকজনকে এমন ঘাতকের আশপাশেই চলাফেরা করাবেন?
স্টেয়ারিং যেসব কাজ করে এসব কাজ বৈধ ট্রাক বা পিকাপে করতে নদী খেকো, ভূমি খেকো, বৃক্ষ খেকো, পরিবেশ দূষণকারী পয়সা ওয়ালাদের অনেক বেশি খরচ হবে??
সড়কে নিরাপত্তা ফেরাতে শ্যালো ইঞ্জিনের অবৈধ গাড়ি আর ড্রাম ট্রাকের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছে উপজেলা পুলিশ-প্রশাসন সেটিই এখন দেখার অপেক্ষায় এলাকাবাসী।